হঠাৎ অ্যালেন স্বপন এর একটা ডায়ালগ মনে পড়ে গেলো। ‘হতাশ, আমি খুবই হতাশ।’
মারুফ ইসলামের ‘দিনের পর দিন’ উপন্যাস পড়ে আমি খুবই হতাশ। এই লেখকের বইয়ের জন্য আমি অপেক্ষা করি। বইমেলাতে দু’দিন ঢু মারতে হয়েছে এই বই পাওয়ার জন্য। কিন্তু যে লেভেলের প্রত্যাশা মারুফ ইসলামের প্রথম উপন্যাস নিয়ে করেছিলাম, সেটার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারলো না বইটি।
তবে আশ্চর্যজনক ভাবে আমার কিছু উপলব্ধি হয়েছে এই উপন্যাস পড়ে। সেটাই তাহলে আগে শেয়ার করা যাক।
উপন্যাসের শুরুটাই হয় একরামের মৃত্যু দিয়ে। একরামের এই অকালে চলে যাওয়ায় স্ত্রী জমেলা বিধবা হয়। ছোট দুই পুত্র আর একটি কন্যা নিয়ে জমেলা পড়ে কূলহীন সমুদ্রে। এই উপন্যাসের সময়কাল প্রয়াত এরশাদ সরকারের আমলে। মানুষের তখন সীমাহীন অভাব। মোজাম্মেলের মায়ের আগমন ঘটে সেই অকূল পাথার থেকে জমেলাকে কূলে টেনে তোলার জন্য। তারপর চাতালের ম্যানেজার, প্রেমিক মিরাজ। যদিও মিরাজ প্রেমিক হয়ে ওঠে আরও বেশ পরে। এর মাঝখান দিয়ে জমেলার দুই ভাই ও ভাবীদেরও কিছুসময়ের পদচারণা লক্ষ্য করা যায় দৃশ্যপটে।
চাতালের ম্যানেজারের মত আরও একজনের দেখা মিলবে ‘কিস্তি স্যার’ চরিত্রে। একরামের চলে যাওয়ার পর জমেলার নতুন জীবনে এসব চরিত্র খুব দ্রুত আসে আর যায়, শুধু মিরাজ থেকে যায়। বলা চলে মিরাজের সাথেই জমেলা যায়। এই যে মোজাম্মেলের মা, চাতালের ম্যানেজার, মিরাজ ও কিস্তি স্যার, সবাই আপনার চারপাশে আছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, আপনার সাথে নিত্য কথা বলছে।
আমি আসলে ভাবছিলাম যে, কিস্তি স্যারের কিস্তি আদায়ের তরিকার দৃশ্য ভেবে। মারুফ ইসলাম এ কী তুলে এনেছেন এই উপন্যাসে! আমি কিছুক্ষণ বই বন্ধ করে বসেছিলাম কিস্তিস্যারের শেষ দৃশ্যের শেষ বাক্য পড়ে।
যাইহোক, একরাম কিন্তু জমেলার জীবনে আর প্রাসঙ্গিক থাকেনা। এটাই মূলত আমার উপলব্ধি হচ্ছিলো- একরাম যদি অনেক আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে যেতেন তাহলেও যা হতো, আবার সীমাহীন দারিদ্রতার মধ্যে রেখে চলেও গিয়েও কম-বেশি তা-ই হচ্ছে জমেলার জীবনে। কিছু এদিক ওদিক হলেও, আসলে চলে যাওয়া একরামেরা আর প্রাসঙ্গিক থাকেনা। পৃথিবীর চরিত্রের ভেতর একটা কর্পোরেট ভাব আছে।
একরাম শুধু জলি আর জামির কাছেই সবথেকে বেশি প্রাসঙ্গিক থাকে, সেটাও হয়তো খুব বেশিদিন থাকবে না। কিন্তু মারুফ ইসলাম হঠাৎ মইমাগঞ্জে জমেলা আর মিরাজের সংসার থেকে জলি আর হামিকে রেখে জামিকে নিয়ে চলে আসে ঢাকাতে।
ঠিক এই জায়গাতে এসে মনে হলো এই উপন্যাস মূলত দু’টি জীবনের গল্প বলতে চেয়েছে, জমেলা ও জামিলের। জমেলার গল্পটা জামিলের তুলনায় স্লো এগুচ্ছিলো কি না এমন ভাবনাও মনে দুয়েকবার এসেছে। তবে জামিলের গল্পটা ভালো লাগছিলো। আশিক স্যার, নিশি, ড্যান্ডিখোর বন্ধুরাসহ আরও বেশকিছু চরিত্রের আগমন ঘটে নতুন এই জীবনে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে জামিলের গল্পটাও হঠাৎ করে শেষ হয়ে যায়, মানেই বইটাই শেষ!
আমি খানিকটা বিরক্ত হয়ে ভাবতে বসলাম, এটা লেখক কী করলেন! এরকম অসমাপ্ত গল্প দিয়ে তিনি কেন উপন্যাস করলেন? শেষতক মনে হলো- লেখক আর কী-ইবা লিখতেন। জমেলার জীবনে কী হবে আর জামিলের জীবনে কী হবে সেটাই তো পাঠকের মনে প্রশ্ন থাকবে, যেমনটা আমার নিজের কৌতূহল ছিলো। কিন্তু উপন্যাস শেষ করে যদি আপনার চিন্তার সাথে ‘দিনের পর দিন’ শব্দ তিনটি জুড়ে দেন তাহলে এখানেই উপন্যাস পূর্ণতা পাবে এবং মনে হবে সঠিক জায়গাতেই শেষ হয়েছে।
সিনেমার পরিচালকেরা যেটা একটা হ্যাপি এন্ডিংয়ে নিয়ে থামাতেন, মারুফ ইসলাম সেটাকে বাস্তবতার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ সব এন্ডিং হ্যাপিনেসের দিয়ে যায় না। এজন্যইতো দেখবেন আপনার চারপাশে জনা দুয়েক মানুষ পাবেন, যাদের জীবন সিনেমার হ্যাপি এন্ডিংয়ের মত হয় না, বরং ‘দিনের পর দিন’র মত হয়।
বইটির অক্ষরগুলো বেশ বড় বড়, ফন্টগুলো আমার কাছে ভালো লেগেছে, অক্ষর বড় হওয়াতে পড়ে আরাম পেয়েছে, তবে এই বড় সাইজের লেখার কারণে বইয়ের পাতা বৃদ্ধি পেয়েছে হয়তো।
প্রচ্ছদ একদেখায় ভালো লাগেনি, তবে ভালোমত খেয়াল করার পর প্রাসঙ্গিক লাগলো, যৌক্তিক লাগলো। একজন বন্ধু বইটি হাতে নিয়েই প্রচ্ছদের প্রশংসা করলেন।
মারুফ ইসলামের লেখার বিষয়বস্তু মূলত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জীবনকে কেন্দ্রকরে ঘুরপাক খায়। আর আমাদের সমাজে এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বেশি। আমার ধারণা তাঁর লেখা পড়লেই আপনি আপনার জীবনের কোন একটি অংশের সাথে রিলেইট করতে পারবেন, আর ঠিক এখানেই আপনি এই লেখকের লেখায় আটকে যাবেন।
তাঁর লেখার ব্যাপারে আমার এক বাক্যের অবজারভেশন- তিনি বিশাল কিছু এখনও লেখেন নি, তবে এক পড়াতেই পাঠক হৃদয়ে কয়েক শতক জায়গা দখল করে নিতে পারেন।
লেখকদের একটা জন্রা থাকে, এটাই মারুফ ইসলামের জন্রা কি না তা সময় বলে দিবে। আমি অন্তত এটুকু আগাম বলতে চাই- মারুফ ইসলাম দিনের পর দিন লেখার চর্চা অব্যাহত রাখলে অনেক দূর যাবেন। তাঁর লেখাতে একটা সূক্ষ্ম সুচ আছে, সেসব একদিন অরগানাইজড হয়ে হৃদয়ে গেঁথে যাবে।
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫