এলিফ্যান্ট রোডে যাবো, ইঁদুর কিনতে। কম্পিউটারের ইঁদুর।

মাঘ মাস হলেও ফেব্রুয়ারির ভরসায় সাহস করে শীতের পোশাক ছাড়াই বের হয়েছি। আমি আবার টেম্পুতে চলাচল করি। আধাকিলোমিটার রাস্তায় একহাঁটু পানি জমে আছে, পানির নিচে ভাঙ্গা রাস্তার গর্তের অভাব নেই, টেম্পু ড্রাইভারের সাথে যাত্রিদেরও বেশ কসরত করতে হচ্ছে ভারসম্য রক্ষায়। দীর্ঘ কসরতের পর ডাঙ্গায় গাড়ি চলা আরম্ভ করলে উচ্চশব্দে মাইকে কথা বলার আওয়াজ ভেসে এলো। কিছুটা শুনে যা বুঝলাম তাতে আমার শীতের ভয় কেটে গেলো, রীতিমত গরম লাগতে শুরু করলো। কম্বল বিতরণ কর্মসূচী চলছে।

টেম্পুর সহযাত্রিরা যেন আলাপের বিষয়ে পেয়ে গেলেন। কেউ বলছেন- ‘এতদিন সময় পায় নাই, এইজন্য শীত গ্যাছে গা, অহন কম্বল দিতাছে।’

এরমধ্যে লাউডস্পিকারে উপস্থাপকের কন্ঠ ভেসে আসছে, অমুক ওয়ার্ডের নেতা মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছে। ভাবলাম কম্বল বিতরণ কর্মসূচিতে মিছিল নিয়ে যুক্ত হয় না কি! হয়তো হতেও পারে, আমার জানার গন্ডি সীমিত। ঠিক আমার পাশের সহযাত্রী নিজে নিজেই বলে উঠলেন- ‘সব টাহা খরচা কইরো না, এত তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় আইত পারবা না।’

যাইহোক, টেম্পু থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। কারণ, যেখানে নামলাম সেখান থেকেই মূলত ট্রাফিক শুরু, সময়কে কাজে লাগাতে চাইলে বসে থাকার উপায় নেই। হাঁটতে হাঁটতে পথ ভুল করে বইমেলাতে ঢুকে পড়লাম। অমর একুশে বইমেলা ২০২৫। তো আর কী করা, এসেই যেহেতু পড়েছি। বইমেলার প্রথম সপ্তাহে পারতপক্ষে আসতে চাই না, নিজ গরজে মেজাজ খারাপ করার কী দরকার! কারণ, বইমেলার মত একটা চমৎকার ইভেন্ট। প্রথম দিন থেকেই পরিপাটি থাকবে, পরিচ্ছন্ন থাকবে, সব স্টলে বই থাকবে, একদম রেডি টু গো কন্ডিশনে থাকবে, এমনটাই প্রত্যাশা। কিন্তু বাস্তবে প্রতিবছর প্রথম ৫-৭ দিন মেলার সোহরাওয়ার্দি উদ্যান অংশে স্টল বানানোর ঠুকঠাক আওয়াজ চলতে থাকবে, সারামাঠে জঞ্জালে পূর্ণ থাকবে, প্রচুর পরিমাণে স্টল ইনকমপ্লিট থাকবে, পাবলিক টয়লেট থাকবে কিন্তু পানির সরবরাহ থাকবে না, তথ্যকেন্দ্র চালু হবেনা, মেলার ম্যাপ স্থাপন হবে না, এইরকম কত যে অসঙ্গতি থাকবে, আপনি ভাবতে গেলে বিরক্ত হয়ে যাবেন।

আচ্ছা বইমেলা কবে শুরু হবে এটা তো সবাই জানে। তবুও কেন এই ইভেন্টের কাজ গোছালো হয় না? কেন স্টলের কাজ, মাঠের কাজ, সকল ব্যবস্থাপনা মেলা শুরু হবার একদিন আগেই ‘রেডি টু গো’ হয় না? লোকবলের অভাব? তাহলে লোকবল বাড়ায় না কেন? সিন্ডিকেট নতুন লোকবলের কোম্পানি ঢুকতে দেয় না? তাহলে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয় না কেন? কাজ শুরু করতেই দেরি হয়ে যায়? তাহলে আরও ৭-১৫ দিন আগে থেকে শুরু করে না কেন? এসবের উত্তর কার কাছে?

আমি সূচিপত্রের স্টল খুঁজছি। এত স্টলের ভেতর স্টল নম্বর না জেনে খোঁজা বোকামি। অন্য স্টলের লোকজনও প্রকাশনির নাম বললে সন্ধান দিতে পারবেনা। আমিও বোকামি করে স্টল নম্বর দেখে আসিনি ওদের ফেইসবুক পেইজ থেকে। অগত্যা লেখক জনাব আব্দুল মাজেদের ফোন থেকে গুগল করে সূচিপত্রের ফোন নম্বর যোগাড় করে কল করলাম। স্টল নম্বর জেনে খুঁজে বের করলাম। গিয়ে দেখি এই স্টলের সামনে দিয়ে অনেকবার গিয়েছি, কিন্তু স্টলের রং করার কাজ এখনও চলছে, বাতি জালানো নেই, এজন্য হয়তো চোখে পড়েনি। সূচিপত্র প্রকাশনির কর্ণধারের সাথেই দেখা হলো। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, স্টল এখনও রেডি হয়নি কেন? তিনি জানালেন, রং করার কাজ যাকে দিয়েছিলাম, সে টাকা নিয়ে ভেগেছে, এখন আরেকজনকে দিয়ে কাজ করাচ্ছি। আজকেই রেডি হয়ে যাবে।

অন্যদিকে বাংলার প্রকাশনের কর্ণধার জনাব আহসান আল আজাদ আছেন মহা ঝামেলায়। নতুন বই ছাড়া মেলা শুরু করা একজন প্রকাশকের জন্য কতটা কষ্টের ও হতাশাজনক তা অন্য কেউ বুঝবে না। আহসান ভাইয়ের হয়েছে এবার সেই অভিজ্ঞতা। তাঁর এবার অনেকগুলো নতুন বই আসবে এই মেলাতে। কিন্তু বইয়ের কাজ শেষ হলেও, শেষবেলায় এসে বাঁধাইখানাওয়ালারা ধর্মঘট করে বসে আছে। বই ছাড়ছে না! ধর্মঘট নাকি আরও সপ্তাহখানেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে, কিন্তু সেটা ছিলো ঢিলেঢালা। এই ঢিলেঢালা ধর্মঘটের মাঝেই অনেক বাঁধাইখানা বই ডেলিভারি দিচ্ছিলো, কিন্তু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা কোন এক বা একাধিক বাঁধাইখানাকে জরিমানা করেছে বই ডেলিভারি দেয়ার অপরাধে, সুতরাং এখন আর কেউ ঝুঁকি নিবেনা। ওহ! কেন ধর্মঘট তা জানবেন না? ওদের মজুরী বাড়িয়ে দিতে হবে, অথচ প্রকাশকেরা মজুরী ফিক্স করেই কাজগুলো দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাদের আবদার মজুরী বাড়িয়ে না দিলে বই দিবেনা। তো এসব গ্যাড়াকলে পড়ে অনেক নতুন লেখক আছেন যারা এবারই প্রথম বই প্রকাশ করছেন, তাদেরও মনোকষ্ট বেড়ে চলেছে।

বই ও বইমেলাকে যতটা ইনোসেন্ট হিসেবে আমরা দেখি, ভাবি। এর পেছনে রয়েছে খুবই ভয়ঙ্কর বাজে প্রাকটিস। তবুও বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। বছরের এই মেলাতে দেশের প্রায় সব প্রকাশনির বই এক জায়গা থেকেই কেনার সুযোগ হয়। ২৫% ছাড়ে বই কেনা যায়, কোন ডেলিভারি চার্জ থাকে না, দৃষ্টিনন্দন স্টল ও প্যাভিলিয়ন দেখা যায়, অনেক মানুষের সাথে দেখা হয়, নতুন নতুন বই যোগ হয় আমাদের ভান্ডারে। বইমেলা ইভেন্ট আরও সুশৃঙ্খল ও সমৃদ্ধ হোক এটাই প্রত্যাশা।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *