মায়ের অভাব

সেলিম হোসেন
বাড়ি ছেড়েছি কুড়ি বছর হলো। বাড়ি থেকে ১০মিনিটের দূরত্ব সমান একটা বাজার আছে।
যতবারই শহর থেকে বাড়ি ফিরতাম, যখনই ফিরতাম আব্বু একটা ভ্যান নিয়ে বাজারে অপেক্ষা করতেন। এখনও করেন।
কখনও কখনও রাত হয়ে যেত পৌঁছাতে, দেখতাম মেজকাকাও অপেক্ষা করছেন। একসাথে গল্প করতে করতে ফিরতাম।
বাড়ি পৌঁছাতে রাত কিংবা ভোর হলে দেখতাম আম্মু বাড়ি ছেড়ে রাস্তার মোড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন।
পদ্মাসেতুর কল্যানে এখন আর রাত হয়না।
আম্মুর অসুস্থতার মাত্রা বেড়েই চলেছে, আব্বুরও চাপ যায়। সকালের ফার্স্ট ট্রিপে আজ এক অন্যরকম বাড়ি ফেরা হচ্ছে, গাড়িতে বসে ভাবছি কীভাবে কী করা যায়, আল্লাহ তুমি সুস্থ করা দাও।
আজ বাজারে কেউ অপেক্ষায় ছিলোনা। একটা ভ্যান নিয়ে নিজেই চলে গেলাম। বাড়ির গেইটেও কেউ ছুটে আসেনি। সাধারণত গেইটের সামনে ভ্যান থামলে আম্মু খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটে আসেন। আজ সব ফাঁকা।
দূরে বাইরের চালার একটা খাটে আব্বু এলোমেলো শুয়ে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু বুঝে উঠে এগিয়ে আসতে একটু সময় লাগলো। সালাম বিনিময়ের পর খেয়াল হলো তিনি একটা আধাভেজা লুংগি পরে বিশ্রাম করছিলেন মাঠ থেকে এসে। আম্মু সুস্থ থাকলে তিনি এই এলোমেলো থাকতেন না।
আম্মু ঘরে বেঘোরে ঘুমুচ্ছেন, সকালে ডাক্তার ইনজেকশন দিয়েছেন। কী আজব, আজ তার আমার জন্য কোন উৎকন্ঠার সুযোগ নেই। মুরগির ঝোল বা পছন্দের মাছের ঝোল গরম গরম পরিবেশন করার তাড়া নেই। রান্নায় একটু দেরী হয়ে যাওয়ায় বিনয় প্রকাশের আয়োজন নেই। পুত্র তার বিশাল ওষুধ, সেই ওষুধ দেখার অবস্থাটাও তার নেই। একটুকরো কাগজের মত বিছানায় পড়ে আছেন।
আব্বু আমার ভাজ করা লুংগি, গামছা, তোয়ালে বের করে দিলেন। এটাও আম্মু রেডি করে রাখেন। নিজে স্নান করে আব্বুকেও স্নানের তাড়া দিলাম।
আগেই অনুমিত ছিলো আজ খাবার সংকট হতে পারে। রাজারহাট নেমে একটা ইন্সট্যান্ট নুডলস নিলাম। আশা গরম পানি এনে দিলে সেটা দ্রুত খেলাম, কারণ ক্ষুধায় অস্থির হয়ে ছিলাম, প্রায় ১৫ ঘন্টা না খাওয়া। লং সফরে না খেয়েই বের হই।
স্নান সেরে আব্বু বললেন খাবারের ব্যবস্থা আম্মু করে রেখেছিলেন সকালে।!
আম্মু চোখ খুললেন আসরের আযানের দিকে, কিন্তু স্বাভাবিক না। ঘুমের ঘোর কাটছে না কোনভাবেই, বুকের ব্যাথাটাও যাচ্ছেনা।
আমি শুক্রবার দুপুরেরর পর আর ঘুমুতে পারিনি। টানা ঘুমহীন, ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত শরীর বারবার বিদ্রোহী হয়ে উঠছে ভেতরে।
শেষতক শুলাম বটে কিন্তু আমার নড়াচড়া খুব অস্থির। এই অস্থিরতার একটা অর্থ আছে, যেটা আমার সহধর্মিণী একপলক দেখেই বুঝে ফেলে। এই অস্থিরতার অর্থ আমার চোখ জ্বলছে কিন্তু ঘুম আসছে না, আর ঘুমের ঘাটতির জন্য পা দুটো ব্যাথা করছে। এসময় সে মাথায় হাত বুলিয়ে কিংবা পা টিপে দিয়ে আমায় ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে, খুব কঠিন কাজ, দীর্ঘ সময়ের কষ্টসাধ্য কাজ, তবু্ও সে চেষ্টা করে আমাকে সুস্থ করে তুলতে। এখন ও পাশে নেই!
শেষ বিকেলে একটু ঘুম হলো, সন্ধ্যা পর্যন্ত দীর্ঘ হলো। রাতে কাকিমার রান্না করা খাবার খেলাম। আম্মুকেও কাকু খাবার দিয়ে গেলেন।
অনেক কিছুই অনেক রকম হতে পারে, আমার এই অন্যরকম বাড়ি ফেরা নিয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই, বরং এটা আমার অন্যান্য অনেক অভিজ্ঞতার মত একটা নতুন অভিজ্ঞতা। সংশয় অনেকসময় বাস্তবে রূপ নেয়।
এই দুনিয়ার সংসার, সভ্য সমাজ বড় অস্থির অসহ্য লাগে, টক্সিক লাগে; খাপ খাওয়াতে পারছিনা। এমন একটা চুপচাপ দ্বীপে গিয়ে যদি জীবন কাটাতে পারতাম, এই মনের ক্লান্তি কিছুটা সেখানেই ডাম্প করতাম।
একটা ইতিবাচক সকালের অপেক্ষায় আল্লাহর কাছে। সুস্থ বাবা মাকে দেখেই যেন কর্মস্থলে ফিরতে পারি।
[আম্মু গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২ তারিখে গ্রামে গিয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম।]

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *