গুপ্তচরবৃত্তি মানব ইতিহাসের বহু পুরনো একটি পেশা। তবে কল্পকাহিনীর স্পাই আর বাস্তবের স্পাই জীবনের বাস্তবতা কিছুটা হলেও ভিন্ন। আমিতো বলবো, মোটাদাগে ভালো রকমের তফাৎ আছে।
তবে তফাৎ যাই হোক, গোয়েন্দা কাহিনী, থ্রিলার পড়তে যারা ভালোবাসেন, তাদের জন্য সত্যিকারের এসপিওনাজ ঘটনাসমৃদ্ধ বই কিছুটা বিরিয়ানির কিংবা ফুচকার স্বাদ এনে দেয়।
সম্প্রতি মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার ‘স্পাই স্টোরিজ ২’ পড়ে শেষ করলাম। পড়ার পর আপাতত ২টি বিষয় নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে।
১. কন্টেন্ট একটি বইয়ের প্রাণ। সেটা ভালো হলে অন্যান্য ত্রুটি পাঠক হিসেবে এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। সেদিক থেকে কন্টেন্ট আমার কাছে ফার্স্টক্লাস লেগেছে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মত ভিন্ন ট্রেড থেকে লেখালেখিতে এসে উন্নতমানের লেখা উপহার দেয়ার ঘটনা অনেক আছে আমাদের বাংলা সাহিত্যে। সেই তালিকায় এই লেখক আপন শক্তিতে জায়গা করে নিয়েছেন। নাম করা অনেক লেখক ও প্রকাশনী থেকে বের হওয়া বইয়ের ভেতর এখন একটা কমন মহামারী দেখা যায়, সেটা হচ্ছে- ‘র’ এবং ‘ড়’ এই দুটো বর্ণ কোথায় ব্যবহার করতে হয় তাঁরা জানেন না। কিন্তু এই বইটি সেদিক দিয়ে দারুণ শান্তি দিয়েছে। ‘শিরোনাম প্রকাশনী’ এর আগে আমি চিনতাম না (সেটা আমার অজ্ঞতা), কিন্তু পুরো শিরোনাম টিমকে অভিনন্দন এমন ‘মহামারী’ মুক্ত একটা বই বাজারে আনার জন্য, পাঠককে বিরক্ত না করার জন্য, শান্তি দেয়ার জন্য।
আমেরিকা আর রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার ‘টম এন্ড জেরি’ খেলা এতটাই উপভোগ্য ছিলো যে, আমার কাছে মনে হয়েছিলো বই পড়ছিনা, সিনেমা দেখছি (আশাকরি এই বইকে উপজীব্য করে ভবিষ্যতে কোন দক্ষ নির্মাতা চলচ্চিত্র বানাবেন)। ‘এজেন্ট বি’ জাস্ট মাইন্ড ব্লোয়িং। কারণ, এক ‘এজেন্ট বি’কে ধরতে গিয়ে কতগুলো স্পাইকাহিনী সামনে চলে এলো, কতগুলো মানুষের গল্প পড়ে ফেললাম মন্ত্রমুগ্ধের মত!
তবে লেখকের একটা সিগনেচার ঢঙ আছে লেখার। সেটা ‘স্পাই স্টোরি’ নামে তাঁর পূর্বপ্রকাশিত একটি বই আছে সেটা পড়লেই বোঝা যাবে। যেমন, তাঁর বই সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা, সুতরাং এখানে রঙ লাগিয়ে পাঠকমনে জায়গা করার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রতিটা ঘটনার একটা পজ লাইন আছে, সাময়িক পজ, সেই পজে/বিরতিতে তিনি নিজের আয়োজনে কিছু বাক্য যুক্ত করে থাকেন। সম্ভবত এই লেখকের সেটাই একটা গোপন মেধা। কারণ বিরতিতে যুক্ত করা নিজস্ব কয়েক বাক্যের মত বা বিশ্লেষণ পুরো ঘটনাকে রঙ্গিন করে দেয়, তাঁর বলার স্টাইলটা এতটাই দারুণ। তবে এটাকে শুধু লেখকের মেধা বলবো না, এটা তাঁর লেখার প্রতি, তাঁর সৃষ্টির প্রতি ডেডিকেশান বা অকৃত্তিম ভালোবাসা।
স্পাই, ডাবল এজেন্ট, ট্রিপল এজেন্টসহ অনেক নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছি। ৬৭টি ফুটনোট আছে এই বইয়ে শুধু অচেনা এসপিওনাজ জগতের সাংকেতিক শব্দের বিশ্লেষণ দেয়ার জন্য। ২২টি রেফারেন্স দেয়া আছে একদম শেষের পাতায়।
স্পাই জীবনের রোমাঞ্চ, বিলাসবহুল জীবন, ক্ষমতা, ঝুঁকি, দারিদ্র, সিদ্ধান্ত, এনালাইসিস, যোগাযোগ, মানে স্নায়ুযুদ্ধ যেন প্রতিটি পাতায় পাতায়। এতটা ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এসপিওনাজ জীবনে বেছে নেয়া মানুষগুলোর জীবন আসলে কেমন হয়? কী হয় শেষতক এসব বিশ্বাসঘাতক এজেন্টদের ভাগ্যে? আর এতসব ভয়ানক ঘটনার মাঝখানে থেকে ‘এজেন্ট বি’ কেন নিজেকে ‘জেমস বন্ড’ ভাবতে গেলেন? ২৫ বছরের কর্মজীবনে ২২ বছরই কীভাবে কেজিবির হয়ে কাজ করে গেলেন? কেনই বা সেটা করলেন? কী ছিলো তাঁর অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব?
সবমিলিয়ে কন্টেন্ট আমাকে ভালো লাগিয়েছে। অবশ্য লেখক ভূমিকাতেই বলেছিলেন, পাঠকের প্রতি অবিচার করবেন না। ইয়েস, তিনি সুবিচারই করেছেন, কথা রেখেছেন। বইয়ের শেষে আমেরিকার এজেন্সিগুলোকে গ্লোরিফাই করে লেখা বই, রাশান এজেন্সি ও এজেন্ট বি নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ ঠিক আমার পাঠকমনের না বলা কথাগুলোই বলেছেন।
২. বইটার মেকিং এতই দারুণ যে, প্রচ্ছদ, কাভার, হার্ডকাভার, পুস্তনি, প্রতিটি পাতার ও অধ্যায়ের অলঙ্করণ, কাগজ, রিবণ, বুকমার্ক সবকিছু এই বইয়ের প্রতি আন্তরিক যত্নের সাক্ষর বহন করছে। মনটা সত্যিই ভরে গিয়েছে বইটি হাতে নিয়ে। প্রচ্ছদ শিল্পী সজল চৌধুরীকে একটা ধন্যবাদ না দিলে অন্যায় হবে। শিরোনাম প্রকাশনী, আপনাদের পুরো টিমকেও ধন্যবাদ জানাই। শুধু প্রচ্ছদ আর অলংকরণ নিয়েই সম্ভবত ১০ মিনিট বলা লাগবে যদি ভিডিও বানাই!
একটা প্রশ্নঃ ১৯৯০ সালে ফেলিক্সের উপর থেকে নজরদারির ইতি টানা হলে ফেলিক্সের জীবন একরকম বিধ্বস্ত হয়ে যায়। শেষতক পাবলিক বাসে ড্রাইভারি করেও বেঁচে থাকতে হয়। কিন্তু ৩২ নম্বর পাতায় একটা ছবিতে ক্যাপশন দেয়া ১৯৯৮ সালে ফেলিক্স ভিয়েনার একটি পার্টিতে। এটা কীভাবে সম্ভব!! আমার ধারণা এটা হবে ১৯৮৮, কারণ ৮৮তে ফেলিক্স চাকরিতে বহাল তবিয়তেই ছিলেন।
পুনশ্চ ০১ঃ যেহেতু এটা একটা সত্য ঘটনার এসপিওনাজ স্টোরি, সেহেতু লেখক বইয়ের ভেতর অনেক চরিত্রের ছবি বিভিন্ন পাতায় দিয়ে দিয়েছেন। যেটা পাঠকের জন্য ভালো লাগার উদ্রেক করবে।
পুনশ্চ ০২ঃ বইমেলার অপেক্ষায় না থেকে, বছরের মাঝে অন্তত আরও একটি বই বাজারে আনলে পাঠকের ক্ষুধা নিবারণ হতো।
গোপন কথাঃ লেখকের নিজের ওয়েবসাইট আছে, সেখানেও অনেক লেখা পাবেন। আমার সব পড়া শেষ, চাইলে আপনারাও পড়তে পারেন।
বইয়ের নামঃ স্পাই স্টোরিজ ২
লেখকঃ মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা
প্রকাশকঃ শিরোনাম
রিভিউ লিখেছেনঃ সেলিম হোসেন