আসুন একটা কেইস স্টাডি করি-

আমরা প্রায়ই মুদি দোকানে যাই। এরমধ্যে কিছু দোকানের লয়্যাল ক্রেতা হয়ে যাই। কেন লয়্যাল হই? এই কারণটা ব্যক্তি বিশেষ নির্ভরশীল হলেও, কিছু কমন কারণ এখানেও আছে। কয়েকটা লিস্ট করা যাক-

১. দোকানদারের ব্যবহার চমৎকার;

২. চাহিদার বেশিরভাগ পণ্য প্রায় সবসময়ই পাওয়া যায়;

৩. অহেতুক দাম চায় না/যৌক্তিক দাম রাখে;

৪. আমাকে চেনে, খাতির করে, সম্মান দেখায়;

মোটাদাগে এগুলোই কমন কারণ, যেসবের জন্য আমরা লয়্যাল হই। এই কারণগুলোর জন্য কোন দোকানদারকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা লাগেনা। এটা ক্রেতার লয়্যাল হওয়ার জন্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হলেও, দোকানদারের জন্য ‘কৌশল’। বিষয়টা অনেকে বুঝেই উপরোক্ত ৪টি কৌশল অবলম্বন করে থাকে, অনেকে প্রকৃতিগতভাবেই এমন যে তাদের চেহারায়, আচার-আচরণের ভেতর ৪টি কৌশল থাকে। 

আমরা মনে মনে চাই যে, আমাদের কেউ চিনুক, দাম দিক। অন্যদিকে দোকানদারও চায় যে, নিজের ওয়েট ধরে রেখে একটু তেল দিই। ফলে এই জায়গায় এসে দুই পক্ষের চাওয়া মিলে যায়। জাস্ট এই মিলে যাওয়ার কারণেই অনেক সময় অচল মাল লেনদেন হয়ে যায়। চার কৌশল আর লয়্যালিটির রসায়ন বাজার ব্যবস্থায় বিরাট ভূমিকা রাখে। 

আমি একবার নতুন একটি এলাকায় বাসা নেয়ার পর, চাউলের বস্তা উপরে ওঠানোর জন্য লোক খুঁজতে লাগলাম। খুঁজতে খুঁজতে পাশের বাজারের এক মুদি দোকানে গেলাম, তার কাছ থেকে দুয়েকদিন কিছু কেনাকাটা হয়েছে। তো তাকে গিয়ে বললাম চাউলের বস্তা উঠানোর জন্য একজন লোক দরকার। তিনি সাথে সাথে ফোন তুলে একজনকে কল দিয়ে আসতে বললেন, এবং মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একজন আসলেন। আমার সাথে পাঠিয়ে দিলেন, আমার সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো। 

দোকানদার ভাইয়ের ফোন করতে কয়েক পয়সা খরচ হয়েছে, পুরোপুরি এক টাকাও না। আবার তিনি আমার কথার গুরুত্ব না দিলেও পারতেন অন্যদের মত, পয়সা খরচ করে ফোন করে এই হেল্প করার দরকার ছিলো না। কিন্ত তিনি করেছেন এবং সেদিন থেকে আমি একটু বেশি ট্রাভেল করে হলেও তার দোকান থেকেই কেনাকাটা করি। জাস্ট এটাই একটা ব্যাপার। 

পাশাপাশি গোটা দশেক সিংগাড়ার দোকান, একই রকম সিংগাড়া, স্বাদও একই রকম। তবুও এই দশটি দোকানের মধ্যে একটি দোকানের সিংগাড়া বেশি চলে, ভীড় থাকে বেশি। কেন? 

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, ঐ দোকানের সসটা একটু অন্যরকম, মজা বেশি, আবার যতবার লাগে ততবারই দেয়, বিরক্ত হয়না। 

প্রতিটি বিজনেসে এমন কিছু ‘সস’ সৃষ্টি করতে পারলে টার্গেটে পৌঁছাতে কিছুটা সহজ হয়। 

আচ্ছা এসবের ভিন্ন চিত্রও তো আছে! চলুন সেগুলো নিয়ে একটু আলাপ করা যাক। 

কিছু দোকানে গিয়ে দেখবেন দোকানদার ফোনে ভিডিও দেখছে। আপনি অন্তত ৩-৪বার বলার পর ফোনের স্ক্রিন থেকে বিরক্ত বদনে চোখ তুলে আপনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করবে আপনার দরকার। তারপরেও সার্ভিস পাওয়াটা সুখকর হবে না। 

এসব ক্ষেত্রে দোকানে যদি কর্মচারী থাকে, ওরাও অনেক ক্ষেত্রে মূল দোকানদারের মতই হয়ে থাকে। 

অনেকে ফোনে ভিডিও দেখে না, তবুও আপনার সাথে এমনভাবে কথা বলে যে, আপনার সাথে তার কথা বলার কোন আগ্রহ নেই, অথবা আপনাকে তার পছন্দ হয়নি এজন্য সে বিরক্ত, বা ধুর ভাই চুপচাপ বসে আছি দোকানে কেন আসলেন টাইপ ভাব; সোজা কথা কাস্টমারকে একটা বিরক্তির উপাদান ভাবে বলেই মনে হয়। অন্তত অভিব্যক্তি তাই বলে। 

এমন কেন হয়? কয়েকটি কারণ খুঁজে দেখা যাক। 

১. তার একটা টার্গেট ছিলো, যেমন মাসে এত টাকার ব্যবসা করবে। হয়তো, সেই টার্গেট অনায়াসে, কোন ধরণের এক্সট্রা ইফোর্ট ছাড়াই প্রতিমাসে অর্জিত হয়। এবং সে এই ব্যাপারে নিশ্চিত যে, প্রত্যাশিত পরিমাণ কেনাবেচার জন্য এতটা সতর্ক থাকার প্রয়োজন নেই। 

২. আশপাশে এমন পরিপূর্ণ স্টকের দোকান আর তেমন নেই। প্রতিযোগী নেই, দোকানে ছাগল বেঁধে রাখলেও বেচাকেনা হবে। 

৩. দোকানের আসল মালিক অপেশাদার/অসৎ কাউকে নিয়োগ দিয়ে বসিয়ে রেখেছে। 

৪. সেলসম্যানশিপ জিনিসটা অনেকের মধ্যে কখনই আসেনা, থাকেনা আবার রপ্ত করতে পারেনা। 

এগুলো হয়তো কমন কারণ। এসব কারণে অনেক ক্রেতা অনেক দোকানে পারতপক্ষে যেতে চায় না, এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু সেটাও সবসময় সম্ভব হয় না। 

আমার বাসার পাশের বাজারে পরিচিত দুটো মুদি দোকান আছে। পিতা পুত্র চালিত দোকান। একটার মেইন হচ্ছে ইয়াং ছেলে, মাঝে মাঝে তার বাবা চালায়। দুইজনের ট্রিটমেন্ট দুই রকম। এবং সেটাই স্বাভাবিক। আমি ইয়াং ছেলেটা থাকলেই কেবল কেনাকাটা করার চেষ্টা করি, তার অভিব্যক্তি রোবোটিক কিন্তু ডিলিংটা পেশাদার। অন্য দোকানটিতে সম্ভবত মেইন পিতা, তবে তারা দু’জন মিলেই সময় ভাগ করে চালায়। দুজনই পেশাদার, তবে যিনি পিতা (বেশ বয়স্ক), তিনিই বেশি পেশাদার, আমি তার সাথেই ডিল করতে সাচ্ছ্যন্দ বোধ করি। 

পাশেই একজন আঙ্কেল আছেন সিজনাল ফল ও ডাব বিক্রি করেন, আমি ঠেকায় না পড়লে তাঁর কাছে যাই না। কিন্তু তাঁর থেকে কয়েক গজ দুরেই আরেকটি আঙ্কেল ফল বিক্রি করেন, তাঁর ফলের কোয়ালিটি মাঝে মধ্যে খারাপ থাকলেও আমি সেখান থেকেই কেনার চেষ্টা করি। 

এগুলো কেন হয়? 

নিজের পেশার সাথে মিশতে না পারার জন্য।

একজন সৃজনশীল গীতিকার যখন পেশার ভেতরে ডুব দিতে পারেন, তখন তিনি ভাবে চলে আসেন আর দুনিয়া জয় করা শব্দমালা দিয়ে গীত রচনা করেন, একজন সুরকার তখন হৃদয় নিংড়ানো সুর সৃষ্টি করে তাক লাগিয়ে দেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *