ভুতের গল্প শোনেনি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। সে শহুরে মানুষ হোক আর গ্রামের, দেশি হোক আর বিদেশি। শেওড়াগাছ, মুণ্ডুকাটা ঘোড়া, সাদা কাপড়ের লম্বা কেউ, হঠাৎ আলোর ঝলকানি, আগুনের গোল্লা ছুটে যাওয়া, মাছ ধরতে গিয়ে মাছ হারিয়ে যাওয়াসহ আরও কতরকম যে ভৌতিক কাহিনী আমাদের ভান্ডারে আছে তা সম্ভবত আলাদা এক সাহিত্যের ধারা তৈরি করার ক্ষমতা রাখে।
এসব আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে শুনে, ভয় পেয়ে পেয়ে বড় হই। বড় হয়ে রাতের বেলায় নির্জন জায়গায় গেলে চুপচাপ মনে মনে ভয় পেতে পেতে বুড়ো হই।
কাজিন কিংবা বন্ধুরা একসাথে হলে ভুতের গল্প করার একটা আলাদা সেশন থাকে। আমরা আসলে নিরাপদ পরিবেশে ভয় পেতে পছন্দ করি। ভয়ে জমে যেতে পছন্দ করি।
এজন্যই ঘরে বসে, লেপের নিচে আধাশোয়া হয়ে, বাতি নিভিয়ে আমরা হরর সিনেমা উপভোগ করি, কিংবা ভুত এফএম এর মতো রেডিও প্রোগ্রাম শুনে ভয় বিলাস করি।
এই ভয় কখনও বিলাসিতা, আবার কখনও যমদূত হিসেবে আবির্ভূত হয়। ভূতের ভয় অনেকের জন্য একটা ভয়ানক হাতিয়ার; এই হাতিয়ার দিয়ে সহজেই শত্রুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে ভূতের উপর দোষ চাপানোর ঘটনা আছে অহরহ। আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ তার একটি সাহিত্যিক উদাহরণ।
ঘটনা ঘটে, রটে; এজন্য ঘটনা, রটনা সবই আমাদের মাঝে আছে। ঘটনা কিংবা রটনার পেছনে থাকে নিরেট ঘটনা; হালের ‘বিহাইন্ড দ্য সিন’। আমাদের সমাজের ভূতের গল্পের ধারক ও বাহক আমরাই। তবে আমাদের মাঝেই খুব অল্পকিছু সংখ্যক ব্যক্তি আছেন যারা সেই ঘটনা-রটনার পেছনের নিরেট ঘটনা বা বিহাইন্ড দ্য সিন খোঁজার চেষ্টা করেন।
এই চেষ্টায় কেউ সফল হন, কেউ হাল ছেড়ে দেন, কেউ শেষতক ঘটনার কারণ খুঁজে পান না, আবার কেউবা সুচিন্তা ও বিশ্লেষণ এবং জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে একটা ব্যাখ্যা দাড় করাতে সক্ষম হন। মূলত ভূতের গল্পের পূর্ণতা পায় এই ব্যাখ্যাতে এসে। কিন্তু ভূতের গল্প আমাদের গ্রামীণ জীবন বা সার্বিক যাপিত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও, এসব নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক সাহিত্য রচনা খুব আছে কি না জানা নেই। বড়জোর কিছু মানুষ পাওয়া যাবে, যারা ‘আরেহ ভূত বলে কিছু নাই’ বলে কেইস ক্লোজ করে দিবেন।
যশোরের লেখক এ জামান পনেরো বছর আগে একবার কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন একটি ‘চাটাম সমগ্র’ প্রকাশ করবেন। আঞ্চলিক চাটাম সংগ্রহ করবেন ঘুরে ঘুরে, এরপর সেটা মলাটবদ্ধ করবেন। বিষয়টা আমার কাছে তখন ইন্টারেস্টিং লেগেছিলো। কিন্তু এখন এসে শুধু ইন্টারেস্টিং না, প্রাসঙ্গিক লাগে। ‘চাটাম’ মানে মিথ্যে গল্প, চাপাবাজিও বলা চলে।
অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ এ প্রকাশিতব্য আবদুল মাজেদের ‘পঞ্চভূত’ একটি আশা জাগানিয়া বই। এই বইয়ে দুই ডজন ভূতের গল্প আছে। কিন্তু ভূতের গল্প তো বাজারে হাজার হাজার আছে, তাহলে এই বই আবার বিশেষ কী?
এখানেই আসলে ব্যাপার। আপনি আপনার অতিথিকে চা বিস্কিট দিবেন, সেটা একটা কাপে চা আর একটা বিস্কিটের প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিতে পারেন, অথবা একটা ট্রেতে চমৎকার করে রূচিশীলভাবে সাজিয়ে উপস্থাপন করতে পারেন। একটা সিনেমা থিয়েটারে বসে দেখতে পারেন, আবার ফোনেও দেখতে পারেন। এই উপস্থাপনার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
পাঠক হিসেবে আমি একটা শার্প পয়েন্ট ডিটেক্ট করতে পেরেছি এই বই পড়ে, তা হচ্ছে- লেখক একটি গল্প বলতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক আরও গোটা তিন চারেক ঘটনার ভেতরে দিয়ে পাঠককে ট্রাভেল করিয়েছেন, ট্রাভেল শেষে ঠিক শুরুর ঘটনায় সময়ে ফিরিয়ে এনেছেন। আবার এই ট্রাভেলটা শুধু ভৌতিক নয়, খানিকটা রম্য, ভয়ের মধ্যে হাসি পেতে পারে; মিষ্টি টকের ঝাল ফুচকা খাওয়ার মত ব্যাপার। এবং সবশেষে চার-পাঁচ দশক আগে ঘটে যাওয়া সেই ভৌতিক ঘটনার একটা চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
রসিকতা করতেও ছাড়েননি নিজেকে নিয়ে। চুড়ান্ত রকমের হিউমার কখন যে ভূতের জগৎ থেকে দালানের শহরে নিয়ে চলে যাবে বুঝে উঠতে সময় লাগবে।
মোটাদাগে পাঠককে টাইম ট্রাভেল করিয়ে গল্প বলার এই চমৎকার কৌশল লেখকের এই বই নিজস্ব বৈশিষ্ট সৃষ্টি করেছে। ২৪ টি ঘটনার ভেতরে আরও যেসব অনুঘটনা রয়েছে, সেসবের রিয়েল ঘটক খুঁজে বের করে পাঠককে আলোকিত করেছেন।
ভূতকে বোতল বন্দি করার ঘটনা আপনি নিশ্চয় শুনেছেন। কাউকে ভূত ছাড়ানোর জন্য ওঝা বা গুনিনের ‘কেরামতি’ বা ‘চিকিৎসা’র ঘটনাও নিশ্চয় শুনেছেন বা সাক্ষী হয়েছেন। এসব চিকিৎসার অধিকাংশই হয় অমানবিক। কখনও কখনও রোগী চিরদিনের জন্য মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে যায় স্থায়ী মেন্টাল ট্রমার কারণে, কারও কারও মৃত্যুও হতে পারে।
লেখক এই বইয়ে ‘বোতল ভূত রহস্য’ নামে একটি গল্প যুক্ত করেছেন। সেই গল্পের শিরোনামের নিচে একটা উপশিরোনাম লিখেছেন – ‘উৎসর্গ- বোতলভূতকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যবর্গ’। এই বিষয়টি আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। একজন লেখকের মানবিক মূল্যবোধের পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পাঁচ শব্দের এই উৎসর্গনামায়। সত্যিকারের জ্ঞান মানুষকে মানুষ করে তোলে, বিনয়ী করে। এটা একটা রুচি, একটা সম্ভ্রান্ত বোধ।
‘বাথানবাড়ির ভূত’ গল্পে লেখকের বন্ধু যখন রাতের অন্ধকারে খেজুরের রস চুরি করে খাওয়ার জন্য গা ছমছম করা বাগানে প্রবেশ করে, সেই বর্ণনা লেখক যখন দিয়েছেন তখনই আপনি বুঝতে পারবেন এই বইটি পড়তে গিয়ে আপনার সময়টা কোয়ালিটি স্পেন্ডে লিখে ফেলেছেন, এবং বাকি গল্পগুলো পড়ার জন্য সিদ্ধান্তে উপনীত হতে প্রভাবিত হবেন।
কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন খাদ্য আছে, খাওয়ার পরে একটা প্রশান্তি বোধ হয়; কিছু সিনেমা আছে, শেষ করার পর একটা প্রশান্তি বোধ হয়। এই বইটা আমার কাছে তেমনই একটি বই। বাংলা সাহিত্যে এমন বইয়ের যোগানে প্রবৃদ্ধি হোক।
আবদুল মাজেদের ‘পঞ্চভূত’র সূচিপত্রটি আপনাদের জন্য এখানে দিলাম-
১. বাথানবাড়ির ভূত
২. করুণ চন্দ্রবিন্দু
৩. বোতলভূত রহস্য
৪. রেস্টহাউসে একরাত
৫. ক্রেতা সাবধান!
৬. চোখের মাইনাস-পাওয়ার ও দাড়ি কাটা-না-কাটার সংকট
৭. বশীকরণ-মন্ত্র
৮. মৌসুমী প্রতারণা
৯. মেছোভূত-রহস্য
১০. রেস্টহাউসের বিড়ম্বনা
১১. ভালো ঘোল
১২. আষাঢ়স্য প্রথম দিবস
১৩. ইরানি মশলা-চা
১৪. জ্যোতিষসম্রাটের ফাঁদে
১৫. দেশি পণ্য কিনে হই ধন্য (রম্য গদ্য)
১৬. জলকুমারী (জলভূত) রহস্য
১৭. চাকরি-জীবনের শ্বাসরুদ্ধকর একঘন্টা
১৮. রটন্তীতলার ভূত
১৯. উড়ুক্কু সাপ রহস্য
২০. এফ.আর.সি.এস জিনের পাল্লায়
২১. গো-ভূত রহস্য
২২. সিঙ্গাড়া সমাচার
২৩. হাগজ
২৪. উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে